সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

তৃতীয় দ্যূতসভা

তৃতীয়দ্যূতসভা
মূল কাহিনী ঃ পরশুরাম (শ্রী রাজশেখর বসু ) 
নাট্যরূপ ঃ অভিযান ভট্টাচার্য 
সূচনা 
[মঞ্চ পর্দা ঢাকা। পর্দার মাঝখানের ফাঁক দিয়ে সূত্রধর বেরিয়ে আসে। সূত্রধরের পেছনে পর্দাঢাকা মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানের  কিনারায় দাঁড়িয়ে সূত্রধর দর্শকদের প্রণাম করে। ] 
সূত্রধর ঃ নমস্কার নমস্কার। আপনারা সব এসে পরেছেন ? বেশ বেশ । আমদেরও প্রায় সব প্রস্তুত। তবে পঞ্জিকায় বলছে আরও ৫ টা মিনিট অপেক্ষা করতে,  বুঝলেন। আপনারা দয়া করে আরেট্টু ধৈর্য ধরে বসুন।  আমি বরং এই ফাঁকে আজকের নাটকের শুরুর আগের গপ্পটা আপনাদের একটু বলে নিই। 
আমাদের এই গপ্পটা হোল আসলে ওই মহাভারতের গপ্প। মানে ওই পাশা খেলার — দ্যূতসভা! 
আপনারা ভাবচেন এতে আর নতুন কি আচে । এত সবার জানা। আজ্ঞে না মশাই । এ গপ্প সে গপ্প নয়। 
আচ্ছা, আপনাদের মহাভারতে পাশা খেলা হয়েছিল কবার? আমি বলছি।  ২ বার। প্রথমবার পাশা খেলে যুধিষ্ঠির হেরে গেলেন । পাণ্ডবরা সর্বস্ব খোয়াল। তখন  ধৃতরাষ্ট্রের মনে অনুশোচনা হল। তিনি পাণ্ডবদের সব ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু পাজী দুর্যধন আর শকুনি মিলে শলা পরামর্শ করে আবার  যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলতে বসায়। এবারেও হেরে পাণ্ডবরা বনবাসে নির্বাসিত হয়।
কি,  তাইতো? 
আজ্ঞে না! আরও একবার পাশা খেলা হয়েছিল মশাই। তৃতীয়দ্যূতসভা ! যুধিষ্ঠির বনাম শকুনি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দিন পঁচিশেক আগে।  কিন্তু কি আশ্চর্য দেখুন —  ব্যাসদেব মহাভারত লিখতে বসে ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেলেন ! কি জানি, কোন রাজনৈতিক কারণ ছিল বোধ হয়। সে যাক গে যাক । এদ্দিনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তর বদলেছে। এখন সে সব কথা ফাঁস করাই যেতে  পারে। আর এই নাটকে আমরা সেটাই করব। 
কি বললেন? আমরা জানলাম কোত্থেকে? আরে মশাই, স্বয়ং পরশুরাম আমাদের বলে গেছেন, পরশুরাআআআআআম!  [বলতে বলতে সূত্রধর পর্দার ভেতরে ঢুকে যায় ।] 
১ম দৃশ্য 
[পর্দা উঠলে দেখা যায় যুধিষ্ঠিরের শিবির।  মঞ্চের মাঝখানে সিংহাসনে যুধিষ্ঠির বসে আছেন । তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সহদেব সুবিশাল একটা ফর্দ নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে  পড়ে শোনাচ্ছেন । যুধিষ্ঠিরের ভাবভঙ্গীতে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর সে সব শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না। মঞ্চের একপাশে ভীম এক গুচ্ছ গদা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। মাঝে মাঝে এক একটা তুলে নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাচ্ছেন আর চিৎকার করছেন “এইটা দিয়ে  দুর্যধন ব্যাটার মাজা ভাঙব” … “এইটা দিয়ে হতভাগা দুঃশাসনের ঘিলু ফাটাব “ … ইত্যাদি ইত্যাদি। মঞ্চের আরেক পাশে নকুল দুজন পেয়াদা নিয়ে কুচকাওয়াজ করছেন —  “ডান বাম , ডান বাম …। সাবধান । ডাইনে মোড় । বাঁয়ে মোড় … “ ইত্যাদি ইত্যাদি।  যুধিষ্ঠিরের এসব ভাল লাগছে না। অধৈর্য  হয়ে যুধিষ্ঠির  সিংহাসন থেকে উঠে মঞ্চের সামনে এসে পায়চারি করতে লাগলেন। সহদেবও পেছন পেছন ঘুরছেন। ] 
সহদেব ঃ যবশক্তু দ্বাদশ মণ, চণকচূর্ণ অষ্টলক্ষ মণ,  অভগ্ন চণক পঞ্চাশ লক্ষ মণ — 
যুধিষ্ঠির ঃ   (অনিচ্ছা সহকারে , কিছুটা সহদেবের মন রাখার জন্য ) ওতেই কুলিয়ে যাবে তো? 
সহ ঃ  খুব খুব। মোটে তো সাত অক্ষৌহিণী সেনা। যুদ্ধ শেষ হতে এই ধরুন দিন কুড়ি। তার মধ্যে মরবেও বিস্তর। তারপর শুনুন। ঘৃত লক্ষ মন — 
যুধি ঃ (বিরক্ত সহকারে) আহ , তুমি তো আমায় পথে বসাবে দেখছি।  এত অর্থ পাবো কোত্থেকে?
সহ ঃ আজ্ঞে অর্থের প্রয়োজনটা কোথায়? সব তো ধারে। যুদ্ধ জয় করার পর মিষ্ট কথায় সব শোধ করে দেবেন। চিন্তা কিসের। তারপর শুনুন। তৈল দ্বিলক্ষ কুম্ভ , লবণ অর্ধ লক্ষ মণ — 
যুধি ঃ থাক থাক । যা ব্যাবস্থা করার কর না বাপু। আমাকে কেন ভোগাও ? আমি রাজধর্ম জানি, নীতি শাস্ত্র জানি। এসব হিসেব কষা বৈশ্যের কাজ।  কতবার বলেছি,  আমার মাথায় ওসব ঢোকে না —  ঢোকে না —  ঢোকে না।  
[প্রতিহারীর প্রবেশ ]
প্রতিহারী ঃ ধর্মরাজ, এক অভিজাত কুব্জ পুরুষ আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। পরিচয় দিতে চাইলেন না। বললেন, তাঁর বার্তা অতি গোপনীয়। আপনার সাথে সাক্ষাতে নিবেদন করবেন।  
সহ ঃ (কাজে বাধা পড়াতে বিরক্ত হয়ে ) মহারাজ, এখন রাজকার্যে ব্যস্ত। ওবেলা আস্তে বল। 
যুধি ঃ না না , ব্যস্ত কিসের। যাও নিয়ে এস। 
[প্রতিহারী বেরিয়ে যায়। একজন কুঁজো বৃদ্ধ প্রবেশ করেন। গলায় রত্নহার। মাথায় পাগড়ী । গায়ে চকড়াবকড়া আলখাল্লা ধরনের জামা। কাঁধে শত তালি বসানো ঝোলা । ইনি শকুনির ভাই মৎকুনি। ]
মৎ ঃ ধর্মরাজের জয় হোক। 
যুধি ঃ কে আপনি সৌম্য? 
মৎ ঃ মহারাজ, ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। আমার বক্তব্য কেবল রাজকর্ণে নিবেদন করতে চাই। 
যুধি ঃ (সহদেবের হাত থেকে ছাড়া পাবার সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে) বটেই তো, বটেই তো । সহদেব তুমি বরং একটু দেখে এস দিকিনি ছোলার বস্তা গুলোতে পোকা ধরে গেল কি না। বাকিরাও সব ঘর খালি কর । আমি এখন কথা কইব। 
[সহদেব, নকুল, ভীম ইত্যাদি সকলে সন্দিগ্ধমনে প্রস্থান করল। ] 
মৎ ঃ (আনুচ্চস্বরে ) মহারাজ, আমি শকুনির বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মৎকুনি। 
যুধি ঃ বলেন কি? আপনি তো আমাদের পূজনীয় মাতুল। প্রণাম প্রণাম । কিন্তু আগে তো কখন আপনাকে দেখি নি ।
মৎ ঃ দেখবেন কি করে মহারাজ। আমি অন্তরালেই বাস করি। গত তেরো বছর বিদেশে ছিলাম। কুব্জটার জন্য ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেকারণে যন্ত্রমন্ত্রবিদ্যার চর্চা করে তাতেই  সিদ্ধিলাভ করেছি। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা আমাকে বর দিয়ে কৃতার্থ করেছেন।   
যুধি ঃ  কি সৌভাগ্য । আপনি দয়া করে ওই বেদিতে আসন গ্রহণ করুন। [দুজনে বসলেন ] এখন কৃপা করে বলুন কি উদ্দেশ্যে আপনার আগমন। 
মৎ ঃ শুনেছি দ্যূতক্রীড়ায় আপনার পটুতা অসামান্য। 
যুধি ঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে ) হুঁ, লোকে তাই বলে বটে। 
মৎ ঃ তথাপি শকুনির হাতে আপনার পরাজয় হয়েছে। কেন জানেন কি?
যুধি ঃ (রাগত স্বরে ) শকুনি ধর্মবিরুদ্ধ কপট পাশায় আমাকে হারিয়েছিল। 
মৎ ঃ (হেসে) দ্যূতে কপট আর অকপট বলে কোন ভেদ নেই। এখেলায় সকলেই দৈবের উপর অবলম্বন করে। একপক্ষ যদি দৈবের ওপর নির্ভর করে, আর অন্য জন পুরুষকার দ্বারা দৈব কে হারিয়ে দেয় তবে পরাজিত পক্ষ কপটতার অভিযোগ আনে।  ধর্মরাজ, আপনার দৈবপাতিত অক্ষ শকুনির পুরুষকারপাতিত অক্ষের কাছে হেরে গিয়েছে। আপনি প্রতিশোধ নিন। প্রবলতর পুরুষকার আশ্রয় করুন। রাবণ বাণের বিরুদ্ধে রাম বাণ  প্রয়োগ করুন। দেখবেন দ্যূতলক্ষ্মী  আপনাকেই বরন করবেন।
যুধি ঃ  মাতুল আপনার কথা তো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না! লোকে বলে , শকুনির অক্ষের অভ্যন্তরে এক পার্শ্বে নাকি সোনার পাত লাগানো আছে। তার ভারেই সে পাশটি সর্ব্দা নিম্নমুখী হয়। আর গরিষ্ঠ বিন্দুর পাশটি উপরে থাকে। 
মৎ ঃ হা হা । লোকে কিস্যু জানে না। স্বর্ন-গর্ভ পাশা নিয়ে খেললেও তার পতন সুনিশ্চিত নয়। বহুবারের মধ্যে কয়েকবার ভ্রংশ হতেই হবে। আপনারা তো অনেক বাজি খেলেছিলেন। একবারও আপনার জিত হয়েছিল? 
যুধি ঃ আজ্ঞে না! 
মৎ ঃ তবে? শুনুন শকুনি কাঁচা খেলোয়াড় নন। অব্যর্থ পাশা না নিয়ে তিনি আপনার সাথে খেলতে বসতেন না। 
যুধি ঃ কিন্তু এখন আর এসব কোথায় কি কাজ মাতুল। যুদ্ধ আসন্ন। পুনরায় দ্যূতক্রীড়া হবার সম্ভাবনা নেই। আর শকুনিকে হারাবার সামর্থ্যও আমার নেই। 
মৎ ঃ নিরাশ হবেন না ধর্মপুত্র । এইবার আমার গূঢ় কথাটি মন দিয়ে শুনুন। শকুনির ওই পাশা আমারই নির্মিত । আমি ওই পাশার মধ্যে মন্ত্রপূতঃ যন্ত্র স্থাপন করেছি। তাই তা অব্যর্থ। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে ) কিন্তু, দুরাত্মা শকুনি যন্ত্র কৌশল শিখে আমাকে গজভুক্তকপিথ্থবৎ পরিত্যাগ করেছে। সে আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল পাণ্ডবদের নির্বাসনের পর দুর্যোধন আমাকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসাবে। আপনারা বনে  চলে যাবার পর যখন দুর্যোধন কে গিয়ে বললাম , সে বল্ল , ‘আমি কিছুই জানি না। মামাকে গিয়ে বল।’ শকুনি বললে ‘দুর্যোধনই যা করার করবে ওকেই বল।’ অবশেষে ছলেবলে দুই নরাধম  আমাকে দুর্গম বাহ্লীক দেশে পাঠিয়ে কারা রুদ্ধ করে রাখল। ১৩ বৎসর পর কোনমতে আমি সেখান থেকে পালিয়ে এসে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
যুধি ঃ বটে। মতলব তো আপনার সুবিধের লাগছে না। এখন আমাকেই অক্ষরূপে চালনা করে রাজ্যলাভ করতে চান ? 
মৎ ঃ (জিভ কেটে ) ধর্মরাজ, আমার পূর্বাপরাধ মার্জনা করুন। যা হবার তা হয়ে গেছে। বামন হয়ে হস্তিনাপুরের চন্দ্রে আমি হাত বাড়াতে গেছিলাম, তাই আজ আমার এই দুর্দশা। আপনি বিজয়ী হয়ে শকুনিকে বিতাড়িত করে আমাকে গান্ধারের সিংহাসনে বসালেই আমি সন্তুষ্ট। 
যুধি ঃ আপনার নির্মিত অক্ষে আমার সর্বনাশ হয়েছে।  এখন কি তারই পুরষ্কার চাইছেন?
মৎ ঃ (কাঁচুমাচু হয়ে ) ও কথা আর তুলবেন না মহারাজ । আমার বক্তব্য সবটা শুনুন দয়া করে। (চুপি চুপি ) আমি গুপ্ত সংবাদ পেয়েছি। সঞ্জয় এখনি ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে আপনার কাছে আসছেন। দুর্যোধন আর শকুনির প্ররোচনায় ধৃতরাষ্ট্র আবার আপনাকে পাশা খেলতে আহ্বান করছেন। মহারাজ, এই সুযোগ ছাড়বেন না।   
[বাইরে রথেরর চাকার ঘর্ঘর শব্দ শোনা গেল। ]
মৎ ঃ (শশব্যস্ত হয়ে ) ঐ সঞ্জয় এসে পড়লেন । দোহাই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন না। বলেবেন, আপনি বিবেচনা করে উত্তর দেবেন। সঞ্জয় চলে গেলে আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলব। আপাতত আমি পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকি। [দৌড়ে মঞ্চের বাইরে চলে গেল। সঞ্জয় প্রবেশ করলেন। ]

যুধি ঃ আসুন আসুন সঞ্জয়। বলুন কি অভিপ্রায়ে আগমন। 
সঞ্জয় ঃ হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! আমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দূত হিসেবে আপনার কাছে এসেছি। ধৃতরাষ্ট্র মহামতি বিদুরকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই  অপ্রিয় কাজে রাজী হলেন না। তাই আমাকেই আস্তে হল। আমি দূত মাত্র। আমার অপরাধ নেবেন না।  ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন — “ বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা পঞ্চভ্রাতা আমার শতপুত্রের মত সমান স্নেহের পাত্র। এই আসন্ন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ যে কোন উপায়ে নিবারণ করা কর্তব্য। আমি অন্ধ, অশক্ত বৃদ্ধ। আমার পুত্রেরা দুর্বিনীত। তারা যুদ্ধে উৎসুক।  আমি চিন্তা করে স্থির করেছি, এই হিংস্র যুদ্ধের পরিবর্তে অহিংস দ্যূতক্রীড়াতেই জয় পরাজয়ের সিদ্ধান্ত হতে পারে। অতি কষ্টে আমার পুত্রগণ ও তাদের মিত্রদের রাজী করেছি। অতএব তুমি সবান্ধবে কৌরব শিবিরে এসে দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হও । পণ থাকবে কুরুপাণ্ডব রাজ্য। যদি কৌরবরা হারে তবে তারা চিরতরে রাজ্যত্যাগ করে বনবাসে যাবে। আর যদি তুমি হারো, তবে তোমাকেও রাজ্যের আশা ত্যাগ করে  সকলকে নিয়ে চিরবনবাসী হতে হবে।  কপটতার আশঙ্কা কোর না। আমি দুই প্রস্থ    অক্ষ সজ্জিত রাখব। তুমি স্বহস্তে নিজের পছন্দের অক্ষ বেছে নিও । অবশিষ্ট অক্ষ নিয়ে  কৌরবদের প্রতিনিধি শকুনি তোমার সাথে ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হবেন। এর চেয়ে অসন্দিগ্ধ ব্যাবস্থা আর কিই বা হতে পারে? সঞ্জয়ের মুখে তোমার সম্মতি লাভের আসায় উদগ্রীব হয়ে রইলাম। তোমার সুমতি হোক, তোমাদের  পঞ্চভ্রাতার কল্যাণ হোক। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা সহ কুরুপাণ্ডবের প্রাণ রক্ষা হোক। “
যুধি ঃ আমার মনে হয় জ্যেষ্ঠতাত স্বয়ংএই বার্তা দেন নি । শকুনি আর দুর্যোধন মন্ত্রণা দিয়েছেন আর কুরুরাজ শুকপাখির ন্যায় সেগুলি উচ্চারণ করেছেন মাত্র। তা, আপনি আমাকে কি করার পরামর্শ দেন মহামতি সঞ্জয়? 
সঞ্জয় ঃ ধর্মপুত্র, আমি আজ্ঞাবাহী বার্তাবাহক মাত্র। নিজের মত জানাবার অধিকার আমার নেই। আপনি আপনার রাজবুদ্ধি, ধর্মবুদ্ধি প্রয়োগ করুন। আপনার মঙ্গল হবে।
যুধি ঃ (কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, মৎকুনি যে দিকে গিয়েছিলেন সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ভাবলেন ) তবে আপনি কুরুরাজকে গিয়ে বলুন যে তিনি আমাকে বড়ই কঠিন সমস্যায় ফেলেছেন। আমি সম্যক বিবেচনা করে তাঁকে উত্তর পাঠাব। আপনি এখন বিশ্রামান্তে আহারাদি করুন। কাল ফিরে যাবেন। 
সঞ্জয় ঃ না মহারাজ, আমার বিশ্রামের অবকাশ নেই। এখনি আমায় ফিরতে হবে। ধর্মপুত্রের জয় হোক।  [প্রস্থান ]
[মৎকুনি পা টিপে টিপে মঞ্চে প্রবেশ করলেন। ]
মৎ ঃ (চুপি চুপি ) মহারাজ আপনি ঠিক কাজ করেছেন। এই বার আমার মন্ত্রণা শুনুন। আজই অপরাহ্নে আপনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এক বিশ্বস্ত দূত পাঠান। কেউ যেন জানতে না পারে। আপনার ভ্রাতারা, দ্রৌপদী, কেউ না।  দূত  গিয়ে বলবে, “ হে পূজ্যপাদ জ্যেষ্ঠতাত, আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য। তৃতীয়বার দ্যূতক্রীড়ায় আমি সম্মত আছি। আপনার আয়োজিত অক্ষে আমার প্রয়োজন নেই। আমি নিজের অক্ষেই নির্ভর করব। শকুনিও তাঁর নিজের অক্ষেই খেলবেন। আপনার নির্দ্ধারিত পণেও আমার সম্মতি আছে। শুধু একটি মাত্র শর্ত আছে। আমরা দুজনেই একটি মাত্র অক্ষ নিয়ে খেলব এবং তিনবার মাত্র অক্ষক্ষেপণ করব। তাতে যার বিন্দুসমষ্টি অধিক হবে তারই জয় হবে। “
যুধি ঃ (বিরক্ত হয়ে ) আপনি সম্পর্কে আমার মাতুল হন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি অতি বাতুল । বলি কোন ভরসায় আমি শকুনির সঙ্গে খেলতে স্পর্ধা করব শুনি? আমি শকুনি যদি একই রকম অক্ষ পাই  তাহলে না হয় সমানে সমানে লড়াই হবে। কিন্তু আমার জয়ের নিশ্চয়তা কোথায়? আর জ্যেষ্ঠতাত যে অক্ষ দেবেন তাতেই  বা আমি আপত্তি করব কেন? আর আমার প্রাণাধিক প্রিয় ভাইদের কাছে সব গোপন করবো! কেন?  আর, আর,  ওই তিনবার দান ফেলারই বা যুক্তি কি শুনি? বেশিবার ফেললেই তো বেশী বেশী সংখ্যা পড়ার সম্ভাবনা ! আচ্ছা, আচ্ছা বলুন তো , আপনি ছদ্মবেশে দুর্যোধনের চর নন তো? এখুনি আপনাকে বন্দী — 
মৎ ঃ ( যুধিষ্ঠিরের পা ধরে ) মহারাজ, স্থির হোন । আপনি আপনার সমস্ত সংশয় ছেদন করছি। শুনুন মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্রের আয়োজিত অক্ষ নিয়ে খেললে আপনার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। ধূর্ত শকুনি সেই অক্ষে খেলবে না। হাতে নিয়ে ইন্দ্রজালিকের ন্যায় বদলে ফেলে নিজের আগেকার অক্ষেই খেলবে। মহারাজ, আমি এতদিন বাহ্লীক দূর্গে নিশ্চেষ্ট বসে ছিলাম না। নিরন্তর গবেষণা করে প্রচন্ডতর মন্ত্রশক্তিযুক্ত অক্ষ উদ্ভাবন করেছি। সেই অক্ষ আপনাকে দেব। সেই অক্ষের কাছে শকুনির পুরাতন অক্ষ একেবারে বিকল হয়ে যাবে! মহারাজ, আপনার জয়ের বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আপনার ভ্রাতারা যুদ্ধ ছাড়া কিছু বোঝেন  না। আপনার মত দুরদৃষ্টি তাঁদের নেই মহারাজ!  তাঁরা আপনাকে বাধা দেবেন ফলে এইরকম রক্তপাতহীন বিজয়ের মহা সুযোগ থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন। তাই আগে আপনি ধৃতরাষ্ট্রকে সংবাদ পাঠান। তারপর ভ্রাতাদের জানাবেন । তাঁরা যদি আপনাকে তিরস্কার করে তবে পর্বতের মত নিশ্চল থাকবেন মহারাজ। 
যুধি ঃ (বসে পড়ে ) ভ্রাতাদের তো না হয় সামলালাম, কিন্তু দ্রৌপদী! ওরে বাবা, ওর কটুবাক্য তো শোনেননি কখনো। শুনলে বুঝতেন। 
মৎ ঃ (হেসে ) মহারাজ, স্ত্রীলোকের ক্রোধ তৃণাগ্নিতুল্য। তাতে কি আপনার মত পর্বত বিদীর্ণ হয়? কিচ্ছু ভাববেন না। কদিনেরই বা ব্যাপার। আপনার জয়ের পর সব নিন্দুকের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।  শুনুন মহারাজ, আমার যন্ত্র অতি সূক্ষ্ম। সেজন্য একদিনে অধিকবার নিক্ষেপ করা বিধিসম্মত নয়। আরও শুনুন, শকুনির অক্ষও বেশীক্ষণ সক্রিয় থাকে না। সেজন্য সে সানন্দে আপনার প্রস্তাবে সম্মত হবে। আপনার জয়ের জন্য তিনবার নিক্ষেপই যথেষ্ট । বিশ্বাস না হয় নিক্ষেপ করে দেখুন। অক্ষ আমার সঙ্গেই আছে।   
[মৎকুনি ঝোলা থেকে পাশা বের করে যুধিষ্ঠিরের হাতে দিলেন। ]
মৎ ঃ মহারাজ, তিনবার ক্ষেপণ করুন।
[যুধিষ্ঠির তিনবার ক্ষেপণ করলেন। প্রতিবার ছক্কা পড়ল। প্রত্যেকবার যুধিষ্ঠির আনন্দে “ছক্কা" বলে লাফিয়ে উঠলেন। তিনবার হয়ে গেলে পাশাগুলি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। মৎকুনি তড়িঘড়ি যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে পাশা কেড়ে  নিয়ে ঝোলায় পুড়ে ফেললেন।  যুধিষ্ঠির ক্ষুণ্ণ হয়ে মৎকুনির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ]  
মৎ ঃ মহারাজ, এই  মন্ত্রপূত অক্ষ বেশী নাড়াচাড়া করলে এর গূনহানি হয়! 
যুধি ঃ আপনার অক্ষ নির্ভরযোগ্য বটে। কিন্তু, কিন্তু আপনি যদি এরপর আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকটা করেন?
মৎ ঃ মহারাজ আমার মুণ্ড আপনার রইল। এখন থেকে আমাকে বন্দী করুন। খড়গধারী দুজন প্রহরী আমার পাহারায় থাকুক। তাদের আদেশ দিন , যদি আপনার পরাজয়ের সংবাদ আসে, তৎক্ষণাৎ যেন আমার মুণ্ডচ্ছেদ করে।                     
যুধি ঃ উত্তম! কিন্তু শকুনির কূটপাশা যদি আমার কূটতর পাশা দ্বারা পরাস্ত হয় তবে তা ধর্মবিরুদ্ধ হবে না কি?
মৎ ঃ হায় হায় মহারাজ! এখনও  আপনার কপটতার আতঙ্ক গেল না? কি মুশকিল। আপনারা দুজনেই তো আমার দেওয়া যন্ত্রগর্ভ পাশা নিয়ে খেলবেন। এতে কপটতা কোথায়? মল্লযুদ্ধে আপনার বাহুবল যদি বিপক্ষের থেকে বেশী হয় তাকে কি কপটতা বলে?  শকুনির কৌশলের থেকে আপনার কৌশল যদি বেশী হয় সেটা কি কপটতা? শুনুন মহারাজ, শকুনির পাশার কূটকৌশল আমার, আবার আপনার পাশার কূটতর  কৌশল — সেও আমার। বস্তুতঃ এখানে আমিই উভয়পক্ষ। আপনি আর শকুনি তো নিমিত্তমাত্র! আপনি এতো ভাবছেন কেন? 
যুধি ঃ আপনার বক্তৃতা শুনে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম। কঠিন সমস্যা। এক দিকে লোকক্ষয় কারী নৃশংস যুদ্ধ, অন্যদিকে কপট দ্যূতক্রীড়া। দুইই অবাঞ্ছিত। যুদ্ধের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা ক্ষাত্রধর্ম বিরুদ্ধ, ওদিকে জ্যেষ্ঠ তাতর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাও রীতিবিরুদ্ধ। (কিছুক্ষণ চুপ ঠেকে ) ঠিক আছে, অগত্যা আমি আপনার মন্ত্রণা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু, আপনি এখন ঠেকে সশস্ত্র প্রহরী বেষ্টিত হয়ে গুপ্তগৃহে বাস করবেন। আমি জয়ী হলে গান্ধার রাজ্য পাবেন। আর পরাজিত হলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। দিন , পাশা আমার হাতে দিন।
মৎ ঃ ধর্মপুত্র, পাশা আপনার কাছে থাকলে পরিচর্যার ওভাবে এর গূণ নষ্ট হবে। আমার কাছেই থাকুক। আমি নিয়ত এতে মন্ত্রধান করব। দ্যূতক্রীড়ায় যাত্রার পূর্বে আমার থেকে নিয়ে নেবেন। ইচ্ছা হলে আপনি প্রত্যহ একবার খেলে দেখতে পারেন। 
যুধি ঃ আপনার তুচ্ছ জীবন আমার হাতে। কিন্তু আমার ধর্ম, রাজ্য সবই এখন আপনার হাতে। তাই আপনার বশবর্তী হওয়া ব্যতীত আমার উপায় নাই। তথাস্তু। 
২য় দৃশ্য
[যুধিষ্ঠিরের সভাকক্ষ। পঞ্চপাণ্ডব বসে আছেন। মধ্যমণি যুধিষ্ঠির গালে হাত দিয়ে চুপ করে আছেন। একটু বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। বাকী চার পাণ্ডব তুমুল কোলাহল করছেন। কারো বক্তব্যই বিশেষ বোঝা যাচ্ছে না। একটু তফাতে দ্রৌপদী বসে আছেন। আলুলায়িত চুল। চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি। হঠাৎ ভীম উচ্চগ্রামে চিৎকার করে উঠলেন। ]
ভীম ঃ না, না । কিছুতেই না । পাঞ্চালী!  পাঞ্চালী তুমি কিছু বল।
দ্রৌপদী  ঃ (পাণ্ডবদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে )  হুঁ ঃ , যে মানুষ এমন নির্লজ্জ যে দু দু বার হেরে গিয়ে চূড়ান্ত দুঃখ ভোগার পরও আবার জুয়ো খেলতে যায়, তাকে আর কি বলব শুনি? 
ভীম ঃ  দুঃশাসনের শোণিতে সিক্ত করে পাঞ্চালীর বেণী বেঁধে দেবার প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম। আপনার এই হীন পরিকল্পনার জন্য  সেই সত্য পালনে আমি ব্যর্থ হব ধর্মপূত্র ।  পাঞ্চালীর পতি রূপে পরিচয় দেব কি করে? হায় হায়, এই প্রস্তাব শোনার আগে আমি বধির কেন হলাম না? 
অর্জুন ঃ আমিও  দুরাত্মা কর্ণ যে অপমান করেছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণের অপেক্ষায় দিবানিশি প্রতীক্ষায় রয়েছি। এই প্রস্তাব অসহনীয়।  সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে একবারও আমাদের অভিমত জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি? 
নকুল ঃ কনিষ্ঠের অপরাধ মার্জনা করবেন ধর্মপুত্র। কিন্তু এই প্রস্তাব কি বীরধর্মের উপযুক্ত? একি ধর্মের অধোগতি নয়? 
সহ ঃ এই যদি হবে তাহলে ধার বাকী করে ভাঁড়ারে এত অন্নাদি সঞ্চয় করার কি দরকার ছিল? 
[যুধিষ্ঠির উঠে দাঁড়ালেন। সকলে হঠাত চুপ করে গেল। ]
যুধি ঃ (ধরা গলায় ) ভ্রাতৃগণ, আমি তোমাদের জ্যেষ্ঠ। আমাকে তোমরা ‘রাজা' বলে থাক। অপরের বুদ্ধি না নিয়েও রাজা নিজের  কর্তব্য স্থির করতে পারেন। যুদ্ধে অসংখ্য নরহত্যার চেয়ে দ্যূতসভায় ভাগ্যনির্ধারণকে আমি শ্রেয় মনে করি। জয় সম্বন্ধে আমি কেন নিঃসন্দেহ তার কারণ আমি এখন প্রকাশ করতে পারব না। যদি তোমরা আমার ওপর ভরসা করতে না পারো তবে স্পষ্ট বল। আমি কুরুরাজকে তাহলে সংবাদ পাঠাব - ‘ হে  জ্যেষ্ঠতাত ,  আমি ভ্রাতৃগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত। তারা আমাকে পান্ডবপতি মনে করে না। দ্যূতসভায় রাজ্যপণের অধিকার আমার আর নেই। আমার অধিকার-ভঙ্গের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আমি অগ্নিপ্রবেশে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছি। আপনি যথা কর্তব্য করবেন।  
[অর্জুন ছুটে এসে যুধিষ্ঠিরের পায়ে পড়লেন। ]
অর্জুন ঃ পান্ডবপতি, আপনি প্রসন্ন হন। আমাদের কটূক্তি মার্জনা করুন। আমাকে সর্ববিষয়ে আপনার অনুগত বলে জানবেন। 
[দ্রৌপদী ব্যতীত সকলেই যুধিষ্ঠিরের পায়ে পরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। যুধিষ্ঠির সকলকে আশীর্বাদ করে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলেন। অতঃপর দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের যাত্রাপথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে সহদেবকে ডাকলেন। ]
দ্রৌপদী ঃ ছোট আর্যপুত্র, হাঁ করে দেখছ কি? ওঠ শিগগির। এখুনি দ্রুতগামী চতুরশ্বযোজিত রথে দ্বারকায় যাত্রা কর। বাসুদেবকে সব কথা বলে এখনি তাঁকে নিয়ে এস। তিনিই একমাত্র ভরসা। তোমরা পাঁচভাই তো পাঁচটি অপদার্থ জড়পিণ্ড। 
[দ্রৌপদী দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে উল্টো দিকে বেরিয়ে গেলেন। চার পাণ্ডব হতভম্ব হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি  করতে লাগলেন। মঞ্চের আলো নিভে গেল।  ]   
৩য়  দৃশ্য    
[কৌরব শিবির। দ্যূতসভা আয়োজন করা হয়েছে। সিংহাসনে বসে আছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। কুরুবংশের প্রবীন দের মধ্যে পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ ইত্যাদি উপস্থিত আছেন। কৃষ্ণ ও বলরাম দুজনেই আছেন। বলরাম কিঞ্চিত মত্ত অবস্থায় রয়েছেন। মঞ্চের মাঝখানে পাশা খেলার আয়োজন করা হয়েছে। পাশার ছকের দুই পাশে শকুনি ও যুধিষ্ঠির বসে আছেন। শকুনির পাশে  দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ ইত্যাদি কৌরবপক্ষীয়রা রয়েছেন। যুধিষ্ঠিরের পাশে  রয়েছেন চার পাণ্ডব। ] 
ধৃত ঃ বৎস দুর্যোধন, অভ্যাগতরা সকলে উপস্থিত হয়েছেন? 
দুর্যো ঃ হ্যাঁ কুরুপতি। 
ধৃত ঃ কৃষ্ণের আসার কথা শুনেছিলাম। এসেছেন?
কৃষ্ণ ঃ হ্যাঁ কুরুরাজ। শুধু আমি নই , অগ্রজ বলরামও উপস্থিত আছেন। আমি আসছি শুনে উনিও আমার সঙ্গী হতে চাইলেন। 
বল ঃ  প্রণাম কুরুরাজ! শুনলাম আপনাদের যুদ্ধশিবিরে যুদ্ধের পরিবর্তে পরম কৌতুকের আয়োজন করা হয়েছে। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ আমি চাই না। কিন্তু, দ্যূতসভায় আমার প্রবল আগ্রহ। তাই আর বিলম্ব না করে দুর্যোধনের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। 
ধৃত ঃ উত্তম! পিতামহ, তাহলে সভার কার্যপরম্পরা শুরু হোক। 
ভীষ্ম ঃ আমি এই দ্যূতসভার সম্যক নিন্দা করি। কিন্তু আমি কুরুরাজের ভৃত্য, তাই অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্বেও আমাকে এই গর্হিত ব্যাপার দেখতে হবে।
দ্রোণ ঃ ঠিক বলেছ। আমি তোমার সঙ্গে একমত। এ ঘোর অনাচার। 
ভীষ্ম ঃ ধৃতরাষ্ট্র, এইসভায় নীতিবিরুদ্ধ কোন কাজ যাতে না হয় তা দেখা তোমার অবশ্য কর্তব্য। আমি প্রস্তাব করছি, কৃষ্ণকে এই সভার সভাপতি নিযুক্ত করা হোক। 
দুর্যো ঃ কক্ষনও নয়। দ্রৌপদীর আমন্ত্রণেই কৃষ্ণ এখানে এসেছেন। উনি পাণ্ডবপক্ষপাতী। 
[কুরুপক্ষের সকলে দুর্যোধনকে সমর্থন করল। ]
কৃষ্ণ ঃ পিতামহ, বিচক্ষণ দুর্যোধন কথাটা একেবারে মিথ্যা বলেন নি।  তাছাড়া আমার অগ্রজ যে খানে উপস্থিত আছেন সেখানে আমার সভাপতিত্ব করা সাজে না। 
ভীষ্ম ঃ বেশ, তাহলে আমি বলরামের নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করছি। সকলের মত আছে তো। 
সকলে ঃ সাধু, সাধু। 
বল ঃ  বিলম্বে কি প্রয়োজন? খেলা আরম্ভ হোক। হে সুধীবৃন্দ, কুরুপক্ষে শকুনি ও পাণ্ডবপক্ষে যুধিষ্ঠির নিজ নিজ একটিমাত্র অক্ষ নিয়ে খেলবেন। প্রত্যেকে তিনবার মাত্র অক্ষপাত করবেন। যার বিন্দুসমষ্টি অধিক হবে তাঁরই জয় । এই দ্যূতের পণ সমগ্র কুরুপাণ্ডবরাজ্য । পরাজিতপক্ষ বিজয়ীকে রাজ্য সমর্পণ করে এবং যুদ্ধের বাসনা ত্যাগ করে সদলে চিরবনবাসী হবেন। হে শকুনি আপনি বয়োজ্যাষ্ঠ। আপনিই আগে অক্ষ নিক্ষেপ করুন।
শকু ঃ এই ছক্কা। 
[শকুনি পাশা ফেললেন । সবাই উন্মুখ হয়ে দেখছেন। পাশা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৌরব পক্ষ চিৎকার করে উঠলেন। ]
দুর্যোধন, কর্ণ  ও অন্যান্য কৌরব  ঃ ছক্কা। আমাদের জয়। 
বল ঃ যুধিষ্ঠির, এবার তোমার পালা।
[যুধিষ্ঠির পাশা ফেললেন। পাণ্ডবরা উন্মুখ হয়ে দেখছেন। পাশা মাটি স্পর্শ করে গড়িয়ে স্থির হল। এবার পাণ্ডবরা চিৎকার করে উঠলেন।  ]
পাণ্ডব ঃ ছক্কা, জয় ধর্মরাজের জয়। 
বল ঃ (বিরক্ত হয়ে ) আঃ ! খামোখা চেঁচাও কেন সব? কারো জয় হয় নি। দুইপক্ষই এখনো সমান।  
শকু ঃ ( পাশা চালতে চালতে ) চিন্তা কোর না ভাগ্নে, আর দুই বারেই আমাদের জয় সুনিশ্চিত। 
[ শকুনি পাশা ফেললেন। সবাই উদগ্রীব। এবারে মাত্র পাঁচ পড়ল। ]
কর্ণ ঃ একি! মোটে পাঞ্জা! 
শকুনি ঃ (সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ) অক্ষ স্থির হয়ে রইল ! একটুও গড়াল না ! 
বল ঃ এবার যুধিষ্ঠির।
[যুধিষ্ঠির দান ফেললেন। এবারও ছক্কা পড়ল। ]
পাণ্ডবরা ঃ (সোল্লাসে ) ছক্কা! জয় ধর্মরাজের জয়।
শকুনি ঃ (একটু দমে গিয়ে দুর্যোধন কে ) চিন্তা কোর না ভাগ্নে। এবারের অক্ষনিক্ষেপ অব্যর্থ। জয় হবেই। 
[দান ফেললেন। মাত্র পুট পড়ল। ]
দুর্যো ঃ (কাঁদো কাঁদো স্বরে ) মাতুল! মোটে পুট ? 
শকুনি ঃ কি জানি ভাগ্নে। অক্ষ গড়ায়না কেন? 
[ যুধিষ্ঠির দান ফেললেন। এবারেও ছক্কা।  পাণ্ডবরা তীব্রস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠল। ]
বল ঃ দ্যূতক্রীড়ায় জয়ী যুধিষ্ঠির।
[কৌরবরা বজ্রাহতের মত বসে আছেন। হঠাত পাশার ছকের দিকে কিছু একটা লক্ষ করে দুর্যোধন চিৎকার করে উঠলেন। ]
দুর্যো ঃ একি! যুধিষ্ঠির পতিত অক্ষ লাফিয়ে লাফিয়ে মাতুল শকুনির অক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে! 
 কর্ণ ঃ মায়া মায়া। কুহক। ইন্দ্রজাল! 
দুর্যো ঃ (বলরামের উদ্দেশ্যে) যুধিষ্ঠির অসাধুতা অবলম্বন করেছেন। তাঁর জয় আমরা মানি না। সাধুব্যক্তির অক্ষ কখনো চলে বেড়ায়? 
(সভায় প্রচণ্ড গোলযোগ শুরু হল। )
বল ঃ বটে!  আমি দুপক্ষের অক্ষই পরীক্ষা করব।
যুধি ঃ যথা আজ্ঞা। এই নিন। [পাশা বলরামের হাঁতে দিলেন । ]
[ শকুনি পাশা নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলেন। ]
শকু ঃ অসম্ভব ! আমার অক্ষ আমি কাউকে স্পর্শ করতে দেব না। 
বল ঃ সভাপতির আজ্ঞা পালনে তুমি বাধ্য।  অমান্য করার স্পর্ধা কোর না শকুনি। [ পাশা কেড়ে নিতে গেলেন । সামান্য ধ্বসটা ধ্বস্তির উপক্রম হল। ] 
শকু ঃ (পাশা আঁকড়ে ধরে  )  আমি আপনার আজ্ঞা বহ নই ! আমার প্রাণ থকতে এই অক্ষ কেউ পরীক্ষা করতে পারবে না। 
[অকস্মাৎ মত্ত বলরাম শকুনিকে এক চড় কশিয়ে শকুনির হাত থেকে পাশা কেড়ে নিলেন। ]
বল ঃ হে সভ্যমণ্ডলী, আমি এই দুই অক্ষই ভেঙ্গে দেখব। 
[ প্রথমে শকুনির পাশা বেদিতে আছড়ে ভাঙলেন । পাশা থেকে কিছু একটা বেরোল। শকুনি ও কৌরব পক্ষ অধোবদন হয়ে রইলেন। ]
ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি ঃ কি সাংঘাতিক! 
[এবার বলরাম উধিষ্ঠিরের পাশা আছড়ে ভাঙলেন। সেটা থেকেও কিছু বেরোল। সেটা দেখে যুধিষ্ঠির “হা ধর্ম! “ বলে মূর্ছা গেলেন। পাণ্ডবরা হতভম্ব । নকুল ও সহদেব দাদাকে বাতাস করতে লাগলেন।  এমন সময় বেদীর ওপর কিছু একটা ঘটতে দেখে সকলে আঁতকে উঠলেন। শুধু শকুনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ]
শকু ঃ খেয়ে ফেললে রে, খেয়ে ফেললে। হা ঈশ্বর এ আমার কি সর্বনাশ হল! (কৌরব পাণ্ডবদের মধ্যে প্রচণ্ড বচসা শুরু হল। প্রায় হাতাহাতির পর্যায়। ) 
ধৃত ঃ (প্রচণ্ড বিচলিত হয়ে ) কি হয়েছে? এত কোলাহল কেন? 
বল ঃ আজ্ঞে বিশেষ কিছু না। একটি ঘুর্ঘুর কীট শকুনির অক্ষে ছিল - 
ধৃত ঃ  কি সর্বনাশ! কামড়ে দিয়েছে? 
বল ঃ কামড়ায়নি মহারাজ। শকুনির অক্ষের মধ্যে ছিল।  এই কীট অতি অবাধ্য। কিছুতেই কাত বা চিত হতে চায় না। অক্ষের ভিতর পুড়ে রাখলে অক্ষ সমেত উপুড় হয়। আর যুধিষ্ঠিরের অক্ষ থেকে একটি টিকটিকি বেরিয়েছে। এই প্রাণী আরও সাঙ্ঘাতিক! স্বয়ং ব্রহ্মা একে কাত করতে পারেন না। টিকটিকির গন্ধ পেয়ে ঘুর্ঘুর বহয়ে অবসন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই শকুনি অভীষ্ট ফল লাভ করেননি। উপরন্তু এইমাত্র টিকটিকিটি ঘুর্ঘুরটিকে ভক্ষণ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছে। 
ধৃত ঃ তাহলে কার জয় হল? 
বল ঃ আজ্ঞে যুধিষ্ঠিরের। দুই পক্ষই কূট অক্ষ নিয়ে খেলেছেন। অতএব কপটতার আপত্তি চলবে না। শুনেছিলাম শকুনি অতি চতুর, কিন্তু এখন দেখছি যুধিষ্ঠির চতুরতর। [এইটুকু শুনে যুধিষ্ঠির মূর্ছা যাওয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে লাফিয়েয়ে উঠলেন। ]
যুধি ঃ কি আমি চাতুরী করেছি! এতবড় অসম্মান! যত নষ্টের গোড়া মাতুল মৎকুনি। শুনুন তবে সব কথা। [মঞ্চের এককোণে বলরামকে নিয়ে গিয়ে কানে কানে যুধিষ্ঠির মৎকুনির কারসাজি ইত্যাদির কথা জানালেন। দর্শকরা কিছু শুনতে পাবেন  না। ভাবভঙ্গীতে বোঝা যাবে। ] 
বল ঃ (যুধিষ্টিরের বক্তব্য শেষ হলে - ) ধর্মরাজ, আপনার কুণ্ঠার কোন কারণ ঙেই! কূটোক্ষের ব্যবহার দ্যূতক্রীড়ার বিধিসম্মত। 
যুধি ঃ (রেগে গিয়ে ) হলধর, আপনি মহাবীর কিন্তু শাস্ত্র কিস্যু জানেন না। ভগবান মনু কি বলেছেন জানেন? “অপ্রাণীভির্যৎ ক্রিয়তে তল্লোকে দ্যূতমুচ্যতে। “ অর্থাৎ, অপ্রাণী নিয়ে যে খেলা তাকেই দ্যূত বলে। কুরুরাজ আমাকে অপ্রাণিক দ্যূতেই আহ্বান করেছিলেন। দুর্দৈববশে আমাদের অক্ষ থেকে প্রাণী বেরিয়েছে। অতএব এই দ্যূত অসিদ্ধ। 
ভীষ্ম ঃ বাহ্ ধর্মরাজ, তুমি সার্থকনামা। 
কৃষ্ণ ঃ(গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ) ধর্মরাজের শাস্ত্রজ্ঞান অগাধ, (যুধিষ্ঠিরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে ) যদিও কাণ্ডজ্ঞানের কিঞ্চিৎ অভাব দেখা যায়। (ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে )  মেনে নিচ্ছি এই দ্যূত অসিদ্ধ। সেক্ষেত্রে পূর্বের দ্যূতও অসিদ্ধ। কারণ শকুনির সর্বদাই ঘুর্ঘুরগর্ভ অক্ষ ব্যাবহার করেছেন।  কুরুরাজ, আপনার শ্যালকের অশাস্ত্রীয় আচরণের জন্য পাণ্ডবগণ বৃথা ত্রয়োদশ বর্ষ নির্বাসন ভোগ করেছেন। এখন তাঁদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিন, নতুবা পরলোকে আপনার নরকভোগ অবশ্যম্ভাবী। 
যুধি ঃ (উত্তেজিত স্বরে ) আমি কোন কথা শুনতে চাই না। দ্যূতপ্রসঙ্গে আমার ঘৃণা ধরে গেছে। আমরা যুদ্ধ করেই হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করব। চল হে ভ্রাতাসকল মৎকুনিকে মুক্তকরে আসি। হতভাগা মূর্খের সমস্ত উদ্যম ব্যর্থ হয়েছে। ওকে প্রবোধ দিতে হবে। একটু নীতি উপদেশ দিয়ে  ছেড়ে দি ।  [পাণ্ডবরা সমস্বরে যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করলেন। সকলে সিংহনাদ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। বাকিরা হতবাক হয়ে রইলেন।  ] 
৪র্থ দৃশ্য
[ কারাগার। মৎকুনি বসে কপাল চাপড়াচ্ছেন। বলরাম, কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদিরা রয়েছেন। ]
মৎ ঃ (কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ) হায় হায়। একেই বলে দুর্দৈব! আমি টিকটিকিটাকে বেশীখাইয়ে অত্যধিক বলবান করতে চেয়েছিলাম।  তাই সেই কৃতঘ্নজীব লম্ফ ঝম্প করে আমার সর্বনাশ করল। বলরাম আর কৃষ্ণ তবু সামলে নিয়েছিলেন, কিন্তু ধর্মপুত্রের শাস্ত্রআওড়ানোর কি দরকার ছিল? সবটা মাটি করে দিলেন!   মুক্তি পেয়ে এখন আমার কি লাভ? দুর্যোধনতো আমাকে নিশ্চয় হত্যা করবে! ও হো হো হো (ক্রন্দন )!
বল ঃ মৎকুনি , কোন চিন্তা করনা । আমার সঙ্গে তুমি দ্বারকায় চল। সেখানে অহিংস সাধুগনের একটি আশ্রম আছে। সেখানে অসংখ্য উকুন-মৎকুন-মশক-মূষিকাদির নিত্য সেবা হয়। তোমাকে তার অধ্যক্ষ করে দেব। তুমি নব নব গবেষণায় সুখে কালযাপন করবে। 
[মৎকুনি জ্ঞান হারালেন । ]

——————————————————— সমাপ্ত  ———————————————————  
              
           
                             
  


রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১১

kripan

কৃপণ (পুনরানুবাদ )
                                        অভিযান  ভট্টাচার্য
______________________________________________________________________

[প্রাক-কথন : আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা | তখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গেছি | ইংরাজি  পাঠ্যসূচীতে রবীন্দ্রনাথের 'কৃপণ' কবিতার একটি ইংরাজি অনুবাদ ছিল | অনুবাদক বোধ হয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ | মূল বাংলা কবিতাটি আমি তখন পড়িনি | হঠাত খেয়াল হলো, আচ্ছা যদি ধরে নি রবিঠাকুর আসলে ওই ইংরাজি পদ্যটাই লিখেছেন, কোনো বাংলা পদ্য থেকে তর্জমা করে ওই পদ্যটার জন্ম হয়নি, তাহলে? চেষ্টা করে দেখিনা এটাকে বাংলা করলে কি দাঁড়ায় | অতএব নেমে গেলাম অনুবাদকের ভূমিকায় | করে    ফেল্লাম কৃপণের ইংরাজি অনুবাদের  'বিপরীত অনুবাদ' | কোনো প্রযুক্তিবিদ হয়ত বলবেন এ এক 'literary reverse engineering' | আমি বলি নিছক পাগলামি | 
আরেকটা কথা | একটি ওমর খৈয়ামের ফার্সি কবিতার বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে অন্তঃপুরচারিনী নারীর সাথে তুলনা করেছিলেন | এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে কবিতাকে অন্য ভাষায় স্থানান্তরিত করলে অন্তঃপুরচারিনীর মতই কবিতার ভাব ও ভাষা যেন অবগুন্ঠনবতী হয়ে থাকে; কিছুতেই তার আড় ভাঙ্গে না | তাই রবিঠাকুরের অন্তঃপুরচারিনীকে স্বগৃহে এনে অবগুন্ঠন উন্মোচনের দুঃসাহস আমার নেই | আমার নিজের শব্দ দিয়ে গড়া কুটির প্রাঙ্গনের গোষ্পদের জলে যদি অন্তঃপুরচারিনীর কিছু ছায়া এসে পড়ে, তাতেই আমার পরম প্রাপ্তি | ]

ভিক্ষা মাগি দোরে দোরে
ফিরিতেছিনু গ্রামের পথে,
হেনকালে ওই অদূরে
দেখিনু তব স্বর্ণ রথে |

উজ্জ্বল সুখ স্বপ্ন সম 
বিস্ময়ে মাতি আজ 
দৃষ্টি পথে এলে ওগো মম
রাজার অধিরাজ !


আশায় আশায় জাগিল প্রাণ
দাঁড়ায়ে রহিনু সেথা,
ভাবিনু বুঝি হ'ল অবসান 
দীন যত দিন হেথা |


ভাবিনু মাগিব কিছুনা মুখে
তোমার কাছেতে আজি ;
বরষিবে তুমি জাগায়ে সুখে
ধুলায় রত্নরাজি |


যেথায় দাঁড়ায়ে ছিলাম আমি
সেথায় থামায়ে রথে,
স্মিত হাসিয়া আসিলে নামি
আমায় দেখিয়া পথে |


সবে ভাবি মনে, বুঝি বা এবার
ভাগ্য আসিল শেষে,
সহসা কহিলে, 'কি আছে দেবার?'
হস্ত প্রসারি হেসে |


ওগো রাজা, একি কৌতুক হায়
করিলে গো মহামতি!
ভিখারীর কাছে রাজা আজি চায়
ভিক্ষা হস্ত পাতি!


বিহ্বল আমি দিশা নাহি পাই |
একটি কনা ধীরে 
ঝুলি হতে আমি তুলে দিয়া যাই 
ক্ষুদ্র কনাটিরে |


দিন শেষে যবে মোর ঝুলি খানি
উপুড় করিনু সাঁঝে
দেখি সেথা একি, এক 'সোনা-কনা' 
আর সব কনা মাঝে !


বিহ্বল আমি কাঁদি বারে বার,
হায়রে হিয়া কৃপণ ;
সঁপিতে সবই তোমায় আমার
চাহে নাই কেন মন!
___________________________